বুকের দুধ খাওয়ানোটা আপনার ও আপনার সন্তান উভয়ের জন্য স্বস্তিদায়ক করার পাঁচ উপায়।
শিশুদের জন্মগতভাবেই মায়ের স্তন খুঁজে নেওয়ার প্রবণতা থাকে। তারপরেও, বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় শিশুর যথাযথ অবস্থান এবং সংস্থাপন (শিশুকে স্তনের সঠিক জায়গায় রাখা যেন সে স্তনবৃন্ত খুঁজে পায়) নিশ্চিত করার জন্য অনেক মায়ের সহায়তা দরকার হয়। সঠিকভাবে বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়টি রপ্ত করার জন্য মা ও সন্তান উভয়েরই অনুশীলন ও সময়ের দরকার হয়।
মা ও সন্তান উভয়ের জন্য সঠিকভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এখানে বেশ কিছু অবস্থানের কথা তুলে ধরা হলো। মনে রাখবেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আপনার সন্তান যেন ভালোভাবে মায়ের দুধ খেতে পারে। দুজনের জন্যই কোন অবস্থানটা সবচেয়ে ভালো সেটা বুঝতে হয়ত আপনার কয়েকবার চেষ্টা করা লাগব।
আপনার যদি কখনো শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে কোনো প্রশ্ন বা উদ্বেগ থাকে তাহলে অবশ্যই আপনার ধাত্রী (মিডওয়াইফ), ল্যাকটেশন বিশেষজ্ঞ বা অন্য স্বাস্থ্য সেবাদানকারীর সঙ্গে কথা বলুন।
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর টিপস
স্তনের সঙ্গে শিশুর ভালোভাবে সংযুক্ত হওয়ার লক্ষণ
- কোনো ব্যথা হবে না ।
- আপনার সন্তানের মুখের নিচের দিকে নয়, বরং ওপরের দিকে অ্যারিওলা (স্তনবৃন্তের চারদিকের কালো অংশ) দেখা যাবে।
- আপনার সন্তানের মুখ বড় করে খোলা থাকবে।
- তাদের নিচের ঠোঁট খানিকটা উল্টে থাকবে।
- তাদের থুতনি আপনার স্তন স্পর্শ করে বা কাছাকাছি লেগে থাকবে আসবে।
আপনার শিশু সঠিক অবস্থানে রয়েছে তা বোঝার উপায়
- আপনার শিশুর মাথা ও শরীর থাকবে এক রেখায়। শিশুর মাথা বাঁকানো বা মোচড়ানো থাকলে সে সহজে স্তন্যপান করতে পারে না।
- শিশুকে আপনার শরীরের কাছাকাছি রাখতে হবে। শিশু দূরে থাকলে সে স্তনের সঙ্গে ভালোভাবে সংযুক্ত হতে পারে না।
- পিঠ বরাবর হাত রেখে শিশুর পুরো শরীরকে সামাল দিতে হবে। বিশেষ করে নবজাতক ও ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বড় শিশুদের ক্ষেত্রে শরীরের ওপরের অংশে সাপোর্ট দিলেও হয়।
- আপনার শিশুকে আপনার দিকে এনে তার নাক বরাবর আপনার বৃন্ত রাখুন। তারা সাধারণত স্তনবৃন্তের নিচ থেকে স্তনে মুখ দেয়।
আপনার শিশু সঠিকভাবে দুধ পান করতে পারছে তা বোঝার উপায়
- আপনার সন্তান আস্তে আস্তে গভীরভাবে স্তনে চাপ দিয়ে দুধ বের করে নেবে। মাঝে মাঝে বিরতি দেবে।
- এক বা দুই বার দুধ চুষে নিয়ে শিশুকে ঢোক গিলতে শোনা যাবে।
- সন্তানের স্তন চুষে দুধ খাওয়াটা আপনার জন্য স্বস্তিদায়ক হবে, কোন ব্যাথা হবে না।
- আপনার সন্তান দুধ খাওয়া শেষ করে স্তন ছেড়ে দেবে এবং তাকে পরিতৃপ্ত, খুশি ও শান্ত দেখাবে।
- শিশুকে দুধ খাওয়ানোর পর আপনার স্তন হালকা লাগবে।
শারীরিক সংস্পর্শের সুবিধা
- এতে আপনি ও আপনার সন্তান উভয়ই শান্তি ও আরাম বোধ করবেন।
- মায়ের শরীরের সঙ্গে শিশুর সংস্পর্শ/সংযুক্তি তার তাপমাত্রা, হৃদস্পন্দনের মাত্রা ও শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে।
- এতে হজম শক্তি বেড়ে খাওয়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে।
- তাছাড়া এটা জীবাণু সংক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষায় সহায়তা করে।
বুকের দুধ খাওয়ানোর অবস্থান
১. ক্রাডল হোল্ড (দোলনা অবস্থান)
এই অবস্থানটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহƒত হয়।এই অবস্থান মা ও শিশু উভয়ের জন্য বেশ আনন্দদায়ক এবং তাদের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় করার পক্ষে বেশ সহায়ক।
- হাতলযুক্ত চেয়ার, সোফা বা খাটের মতো কিছুতে বসুন যাতে সঠিক উচ্চতায় হাত দিয়ে আপনার শিশুকে ধরে রাখার জন্য সাপোর্ট পাওয়া যায়। প্রয়োজনে হাতে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য বালিশ ব্যবহার করতে পারেন।
- ছোট্ট সোনামনিকে আপনার কোলের মধ্যে নিন। তার মাথা আপনার হাতের কনুইয়ের ভাঁজের মধ্যে থাকবে।
- শিশুর বুক আপনার বুক বরাবর রাখতে হবে, যাতে আপনার স্তনের দিকে এগোতে তার মাথা ঘোরাতে না হয়। প্রয়োজন হলে শিশুর মাথায় সাপোর্ট দেওয়ার জন্য বালিশ ব্যবহার করুন।
২. ক্রস ক্রাডল হোল্ড
প্রথম সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় এই অবস্থানটা উপকারী এবং একেবারে ছোট শিশুদের জন্য একটা দারুন অবস্থান। এই অবস্থানের মাধ্যমে আপনার সন্তানের মাথার ওপর আপনার ভালো নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব। এই অবস্থানকে ক্রাডল হোল্ডের বিপরীত হিসেবে চিন্তা করুন। এর জন্য ক্রাডল হোল্ডের বিপরীত দিকে শিশুকে রাখুন। এখানে তার মাথা আপনার হাতের কনুইয়ের ভাঁজের মধ্যে নয়, বরং হাতের মধ্যে রাখতে হবে।
৩. ফুটবল বা রাগবি হোল্ড
আপনার স্তন যদি ফুলে যায়, শক্ত হয়ে থাকে, আকারে বড় হয়ে যায় বা এমন কোনো সমস্যা হয় অথবা স্তনবৃন্তে ঘা/ক্ষত হয় তাহলে এই অবস্থান উপকারী হতে পারে। ফুটবল বা রাগবি হোল্ড স্তনের নালাগুলো আটকে যাওয়া প্রতিরোধে সহায়তা করে। এটা মা ও সন্তান উভয়ের জন্যই উপকারী।
- শিশুকে যখন আপনার দিকে ধরবেন তখন তাকে আপনার কোল বরাবর ফুটবল বা রাগবি বলের মতো করে ধরবেন। শিশুর শরীর আপনার বাহুর মধ্যে মুখ আপনার স্তনের দিকে থাকবে।
- শিশুর পা দুটো আপনার বাহুর নিচে থাকবে।
- আপনার অপর হাত শিশুর সুবিধামতো জায়গায় স্তন রাখতে ব্যবহার করবেন।
যদি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আপনার সন্তান হয় এবং একারণে পেটের ওপর সন্তানকে রাখতে না পারেন, তাহলে ফুটবল বা রাগবি হোল্ড আপনার জন্য খুবই উপকারী।
৪. পাশাপাশি শোয়ার অবস্থান (সাইড লাইয়িং পজিশন)
আপনি ও আপনার সন্তান যদি শুয়ে বুকের দুধ খাওয়ানো ও খাওয়ায় স্বস্তি বোধ করেন, তাহলে এই অবস্থানে চেষ্টা করাটা দারুণ হবে।
- আপনি আপনার পাশে শুয়ে সন্তানকে আপনার দিকে মুখ করে শোয়ান। তাকে এমনভাবে শোয়াতে হবে যেন তার মাথা আপনার স্তনে থাকে।
- আপনার পেছনে বালিশ রেখে সাপোর্ট নিতে পারেন এবং এক্ষেত্রে একটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে যে, আপনার সন্তানের নাক যেন ঢাকা পড়ে না যায়।
৫. হেলান দেওয়া অবস্থান (রিক্লাইনিং পজিশন)
আপনার ছোট্ট সোনামনির যদি বুকের দুধ খেতে সমস্যা হয় বা সে অবিরাম কাদতে থাকে তাহলে তাকে শান্ত করার জন্য এই অবস্থানে বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এই অবস্থানকে কখনো কখনো ‘প্রাকৃতিক’ও বলা হয়ে থাকে।
- বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ুন এবং এমনভাবে হেলে থাকবেন যেন সন্তান আপনার হেলানো শরীর থেকে সাপোর্ট পায়। কোনোভাবেই শরীর পুরোপুরি সোজা করে রাখা যাবে না।
- শিশুকে আপনার বুকের ওপর ছবির মতন করে রাখুন তার শরীরের সঙ্গে আপনার শরীরের সংস্পর্শের জন্য শিশুকে খালি গায়ে আপনার খোলা বুকের ওপর রাখুন এবং ছোট্ট সোনামনির সঙ্গে আপনার বন্ধন তৈরী করুন।
বিশেষ এই সময়টিকে উপভোগ করূন এবং আপনার সন্তানের সঙ্গে গভীর বন্ধন তৈরী করার কাজে লাগান। মনে রাখবেন, সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোটা আনন্দদায়ক হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। ধৈর্য ধরতে হবে এবং প্রয়োজন হলে, আপনার স্বাস্থ্য সেবাদানকারীর শরনাপন্ন হতে হবে।